নটর ডেমে হোস্টেল লাইফ কাটাতে যে ব্যাপারগুলি মাথায় রাখতে হবে

মো: ইউছুপ

মো: ইউছুপ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

এই লেখাটি তাদের জন্য, যারা কলেজ লাইফে প্রবেশ মাত্রই হোস্টেলে ওঠার চিন্তা করছো অথবা স্কুল জীবন হোস্টেলে কাটিয়ে এখন কলেজ জীবনও হোস্টেলে কাটাবে।
পার্ট বাই পার্ট লেখার চেষ্টা করবো, যাতে তোমাদের বুঝতে সুবিধা হয়।

🟡 হোস্টেল জীবন নিয়ে কিছু কথা:

 শিক্ষা জীবনের বাঁকে বাঁকে আমাদেরকে নানান ধরনের পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে চলা লাগে। কোনটার পথ অনেক সহজ হয়, আর কোনটার পথ হয় কঠিন এবং বিষাদময়। ঠিক হোস্টেল জীবনও একজন ছাত্রের জন্য কঠিন, বিষাদময় এবং সহজ ও হতে পারে। যে যেভাবে মানিয়ে নিতে পারে। 

হোস্টেল জীবনের এই অধ্যায়টি সারা জীবনের একটা শিক্ষা হয়ে থাকে। নানান এলাকার, সংস্কৃতির,ধর্মের এবং পরিবেশের মানুষের সাথে থাকতে হয় একই ছাদের নিছে। ধর্ম- বর্ণ নির্বিশেষে এরাই আবার আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠে। নবাগতদের জন্য হোস্টেল জীবন হয়তো আতংকের নাম, অন্যদিকে প্রাক্তনদের জন্য এটা হয়তো আবেগের জায়গা। হয়তো পার হয়ে যাওয়া ছেলেটিও খুব মিস করে এই লাইফটাকে। বার বার সেই বন্ধুদের সাথে দেখা হলে বলে উঠে বন্ধু! আর কি পারবো সেই লাইফে ফিরে যেতে? না! কখনোই না; জীবনের স্রোতে আমরা চলে এসেছি অনেকদূরে। আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়!
আনন্দ, আড্ডাবাজি, খুনসুটির মধ্যে কাটানো এই জীবন মানুষের লাইফে অনেক কিছু শিক্ষা দিয়ে যায়।

🟡 নটরডেমিয়ানদের হোস্টেল জীবন:

কলেজ, কুইজ, ল্যাব,কোচিং সবকিছু থেকে বেরিয়ে হোস্টেলে গিয়ে শান্তির নিশ্বাস! আহা কত শত প্যারা শেষ করে বালিশে মাথা লাগিয়ে একটু শান্তি দেই মাথাটাকে। সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজটা পড়েই আবার গিয়ে একটু ঘুমিয়ে নেই। ঘুম থেকে উঠে দেখি ৭:৪৫ বেজে গেছে! হায় কি হবে এখন? এক দৌড়ে গিয়ে মুখে পানি দিয়ে খাবার টা নিই। দুমুঠো কোনভাবে খেয়ে; রেডি হয়ে যেতে যেতে বেজে গেলো ৭:৫৯ মিনিট। গেট বন্ধ হবে ৮.০০ টায়। দরোয়ান মামা র কালো মুখ দেখে কলেজে প্রবেশ। দৌড়ে টিম বিল্ডিংয়ের ৩৫৮ নং রুমে যাচ্ছি। নাইঈমুর স্যারও দরজার সামনেই চলে গেছে প্রায়ই। আমি আরো জোরে দৌড়েও স্যারের আগে ক্লাসে ঢুকতে ব্যর্থ হলাম! স্যারকে বলি “মে আই ক্যাম ইন স্যার?”
স্যার উত্তর দিলো “লেট কেনো?কান ধরে দাঁড়িয়ে থাক ওখানে; যাতে বাকি ক্লাসগুলো থেকে তোকে দেখা যায়”। এত সংগ্রাম করে এসেও ক্লাস ধরতে না পারা ছেলেটাই হোস্টেলে থাকে। ক্লাসের মধ্যে সব স্যারের ক্লাসে ঘুমানো যায় না। উইলিয়াম ব্রায়েন স্যারের ক্লাসে ঘুমানোর একটু সুযোগ থাকে। মরিয়া হয়ে চেয়ে থাকি কখন ব্রায়েন স্যারের ক্লাস আসবে আর ৪০ মিনিটের একটা ঘুম দেবো। অত্যন্ত ক্লান্ত শরীরে কোনমতে ৮ম ক্লাসটা শেষ করেই হোস্টেলের দিকে দৌড়। ফ্রেশ হয়ে নামাজটা শেষ করেই চলে যায় মিলের বাটি নিতে। অত্যন্ত দ্বিধাদ্বন্দের মধ্যে খুঁজে সঠিক বাটিটা বের করতে হয়। মনে হয় এখানেই বুঝি লাইফের বড় সিদ্ধান্তটা নিতে হয়! না জানি ঠকে যাই খাওয়া শেষ করেই আবার কলেজের দিকে দৌড়। উদ্দেশ্য আইসিটি ল্যাব। ল্যাবে সঠিক সময়ে পৌঁছাতে পেরেছি। কিন্তু আমার কিছু বন্ধু সঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারে নি তাই ওরাও কান ধরে ভেতরে প্রবেশ করছে। একদিকে আরিফ স্যার সিরিয়াস হয়ে HTML এর কোডিং বুঝাচ্ছে, অন্যদিকে আমি আর বন্ধুরা মিলে ডেস্কটপে তাস খেলছি। স্যার আসলেই পেইজ পরিবর্তন করে কোডিংয়ে যাচ্ছি। এভাবে শেষ হলো ল্যাব। এবার যাচ্ছি হিসাববিজ্ঞান প্রাইভেটে। প্রাইভেট শেষ করে হোস্টেলে আসতে আসতে মাগরিবের আযান হয়ে যায়। এসে সব রেখে নামাজ শেষ করে একটু কিছু খেয়ে রেস্ট করতে করতে বেজে যায় ৮/৮.৩০ টা। বই খুলে পড়া রেডি করতে করতে বেজে যায় ১.০০ টা। তারপরে শান্তির ঘুম। আহা! সকালে উঠে আবার সংগ্রামে নেমে যেতে হয়। আর কুইজ থাকলে সেই রাতে আর চোখে ঘুম আসে না। সারা রাত পড়ে সকালে ১/২ ঘন্টা ঘুমিয়ে চলে যায় কুইজ দিতে।

জুমাবার এবং শনিবার একজন নটরডেমিয়ানের লাইফে কিজে আনন্দ দেয় সেটা বলে বুঝানো যাবে না। সাপ্তাহিক সব ময়লা কাপড় ক্লিন করা, রুম পরিষ্কার, শেষে ফ্রেশ হয়ে জুম্মায় যাওয়া সবার সাথে। মাসজিদে বাকি হোস্টেলের বন্ধুদের বা ভাইদের সাথে দেখা হয়। আড্ডা দিয়ে রুমে এসেই স্পেশাল মিলের জন্য ভিড় জমাতে হয়। বিকেলে বন্ধুদের সাথে খেলতে যাওয়া বা ঘুরতে যাওয়া কতই না আনন্দের। শনিবারে পুরোদমে ঘুম আর কুইজ বা টার্ম থাকলে একটানা পড়ায় সময় কাটে। এভাবেই চলতে থাকে একজন নটরডেমিয়ানের হোস্টেল জীবন।

🟡 বাড়ির পরিবেশ VS হোস্টেলের পরিবেশ:

বাড়িতে থাকি রাজার হালে আর হোস্টেলে হতে হয় নিজের কামলা। বাড়িতে সারাদিন এদিকে ওদিকে ছোটাছুটি করে বাসায় আসি; মা আদর করে খায়িয়ে দেয়। অন্যদিকে হোস্টেলে নিজের সব কাজ শেষ করে খেতে বসতে হয়। বাসায় বিছানাটা মা পরিষ্কার করে দেয়,অন্যদিকে হোস্টেলে নিজের বিছানা, রুম, জামাকাপড় সব নিজেকেই পরিষ্কার করতে হয়। অনেকেই প্রথমে এসে এসব পারে না। তাই তাদেরকে বলবো এখন থেকে মাকে কষ্ট না দিয়ে নিজের কাজ নিজে করতে শিখো। তাহলে হোস্টেলে সার্ভাইভ করতে সহজ হবে। বাড়িতে বাবা মা মাঝে মাঝে ভালো কিছু রান্না করে খাওয়ায় যেটা এখানে একদমই পাবে না যতক্ষণ না বাড়ি থেকে কেউ আসার সময় নিয়ে আসে।ইন্ট্রোভার্ট ছেলেদের জন্য এই লাইফ খুবই কষ্টের। বাসায় ইন্ট্রোভার্ট হয়েও থাকা যায়। কিন্তু হোস্টেলে সম্ভব না। এখানে সবার সাথে সবার যোগসূত্র থাকা লাগে। পরস্পরের সহযোগিতা থাকলে অনেকক্ষেত্রেই সুবিধা পাওয়া যায়। বাসায় একা নিজের রুমে নিজে থাকলেও এখানে আরেক এলাকার,ধর্মের, পরিবেশের আরেকজনের সাথে তোমাকে থাকা লাগতে পারে। রুমমেটের ভালো খারাপ দেখতে হয়। মিলেমিশে থাকাটা সহজ হয় যদি দুজন একই ক্লাসের বা একই এলাকার কয়েকজন বন্ধু মিলে থাকা যায়। সর্বোপরি মিলেমিশে থাকার অভ্যাস থাকলে তোমার জন্য সার্ভাইভ করাটা সহজ হবে।

🟡 একদম নতুনভাবে যারা হোস্টেল জীবন শুরু করতে যাচ্ছো:

শান্তির নীড় হতে অশান্তির নীড়ে তোমায় স্বাগতম হে নবীন! আসলেই কি অশান্তির নীড়? না; মোটেও না।
সর্বপ্রথম সিউর করে আসবা তোমার সব কাজ তুমি নিজে করতে পারো কি না। সবার সাথে যেকোনো পরিবেশে মিশতে পারো কি না। একই ছাদের নিচে হয়তো তোমাকে অন্য ধর্মের বন্ধুর সাথে থাকা লাগতে পারে। তার আচার-আচরণ, ব্যবহার তোমার মতো নাও হতে পারে। কোন সমস্যা নেই! সবার সাথেই মিলেমিশে চলতে পারবে যদি তুমি নিজেকে একটু প্রকাশ করো। শুধু রুম থেকে কলেজে আবার কলেজ থেকে রুমে এভাবে মোটেও থাকা যায় না। সবাই তোমার সাথে মিশতে চাইবে; তুমিও মিশবে। তাহলে তোমার নেটওয়ার্কিং স্কিল বাড়বে।কোন সমস্যায় পড়লে বন্ধুরা তোমাকে চিনবে এবং সাহায্যে এগিয়ে আসবে। বিশ্বাস করো? তুৃমি যদি একটু সুন্দর মতো এক সপ্তাহ মানিয়ে নিতে পারো তাহলে সামনের সপ্তাহও তুমি অটোমেটিক মানিয়ে নিতে পারবা। তার জন্য দরকার বন্ধু। বন্ধু বানিয়ে হোস্টেলে উঠবা অথবা হোস্টেলে উঠার পরে বন্ধু বানাবা। সিনিয়র ভাইদেরকে সম্মান করবে সর্বদা। সালাম দিয়ে, খোঁজ- খবর নিয়ে ওনার কাছে প্রিয় হবা। তাহলে তেমার নিজেরই লাভ। পড়াশোনা জনিত কোন সমস্যায় ভাই তোমাকে সাহায্য করবে।

🟡 হোস্টেলে উঠতে কী কী নিয়ে আসতে হয় বাড়ি থেকে:

স্বাভাবিকভাবেই একজন মানুষের মৌলিক যা যা দরকার হয় তাই নিয়ে আসবা। ভিআইপি টাইপের হোস্টেল হলে বালিশ আর তোশক ওরাই দিবে। এটা আগে থেকেই জেনে নিবা হোস্টেল বুক দেওয়ার সময়। একটা প্লেট, বাটি, গ্লাস, মগ, পানির বোতল, হিটার, টুপি, নামাজের ম্যাট, আয়না,চিরুনি, মগ,বালতি, গামছা/তোয়ালে, ছোট একটা কাঁথা, কলম রাখার ঝুড়ি, অবশই একটা ট্রলি/ট্রাংক, টেবিল লাইট, টিস্যু, সাবানের কেছও সাবান,সার্প এক্সেল, টেবিল গড়ি,ক্যালেন্ডার,ছাতা ইত্যাদি জিনিসপত্র আনলেই হবে আশা করি।

🟡 হোস্টেল জীবনের বন্ধুরা:

২০১৭ সাল থেকে হোস্টেলে থাকা শুরু করি। শুরুটা হয় নোয়াখালী শহরের ছোট একটি স্কুলের হোস্টেল দিয়ে। সেই থেকে এখন অবধি হোস্টেলেই থাকছি। এই জীবনটা ছাড়তে মোটেও ইচ্ছা করে না। নেশা একটাই হোস্টেলের মজা! এই মজা আমাকে খুব লোভ দেখায়। কারণ শহরে আমাকে থাকতে হলে নিজে বাসা নিয়ে বা ম্যাসে থাকতে হবে। তারচেয়ে হোস্টেল বেশি ভালো লাগে। একমাত্র কারণ হলো বন্ধুরা। এখানে এমন কিছু বন্ধু তৈরি হয় যারা জীবনের সাথে মিশে যায়। আপনার জীবনের সোনালী সময়গুলো তাদের সাথে কাটে। একেকজনের একেক নিক নেইম, রাতে মতিঝিলের গলিতে ক্রিকেট খেলা, মান্ডায় গ্রিন মডেলের মাঠে ফুটবল টুর্নামেন্ট, রুম আড্ডা, মুড়ি পার্টি, নুডলস পার্টি, সাপ্তাহিক স্পেশাল মিল, শর্ট ট্যুর, একসাথে মসজিদে যাওয়া এই বিষয়গুলো তোমাকে খুব কাছে থেকে আপন করে নিবে ধীরে ধীরে। নটরডেম কলেজ হলো এক ছাদের নিছে সারা বাংলাদেশ! নটরডেমিয়ানদের হোস্টেল জীবনের যেসব বন্ধু হয় তারা একেকজন একেক জেলার হয়ে থাকে। কোথাও কোন জেলায় ঘুরতে গেলে বা কোন সমস্যায় পড়লে বন্ধুর অভাব হয় না। ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাবা চট্টগ্রাম, রাজশাহীতে? কোন সমস্যা নেই, বন্ধুর বাসা তো আছেই। একটা সময় কলেজ জীবন শেষ হলে এরা আবার চান্স পায় একেকজন একেক জায়গায়। তখন ক্যাম্পাস ট্যুর হয় আরো জমকালো! বন্ধুর ক্যাম্পাস; বন্ধুর দাওয়াতে প্রায়ই ঘুরতে যাওয়া যায় ভিন্ন ভিন্ন ক্যাম্পাসে। তারপর চাকরি জীবনেও এরা একেকজন একেক জায়গায়। তখনও যেকোনো সাহায্যে মন খুলে বলা যাবে “ও আমার হোস্টেল ফ্রেন্ড ছিলো”।
এভাবে তোমার বন্ধুদের সাথে হোস্টেল জীবন হয়ে উঠবে আরো আনন্দময়।

🟡 তোমার জীবনে হোস্টেল জীবনের প্রভাব:

একজন হোস্টেলে থাকা কলেজ স্টুডেন্ট যখন ভার্সিটি লাইফে প্রবেশ করে তখন তাকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হলে থাকতে হয়। এক্ষেত্রে কলেজে যারা হোস্টেলে ছিলো তাদের জন্য অনেক সহজ হয়ে যায় সার্ভাইভ করতে। হোস্টেলে থাকা স্টুডেন্টদের কমিউনিকেশন স্কিল খুব ভালো থাকে। যেকোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিয়ে থাকার ক্যাপাবিলিটি তৈরি হয়। চাকরি জীবনে অনেকের পরিবার ছেড়ে দূরে থাকতে হয়। যারা হোস্টেলে থাকার অভিজ্ঞতা আগে থেকে থাকে তাদের জন্য এই বিষয়টা আরো সহজ হয়ে যায়। কারণ তারা আগে থেকেই পরিবার ছাড়তে অভ্যস্ত। যেকোনো ধর্ম, বর্ণ,গোত্রেরও এলাকার মানুষের সাথে মানিয়ে থাকার অভিজ্ঞতা আগে থেকেই তৈরি থাকে। মদ্দা কথা হলো যারা হোস্টেলে থাকে তারা সব ক্ষেত্রেই বাসায় থাকা ইন্ট্রোভার্ট ছাত্রদের থেকেও অনেকদূর এগিয়ে থাকে।

আশা করছি আমার এই লেখা থেকে একটু হলেও নতুন কিছু জানতে পেরেছো বা আন্দাজ করতে পারছো কেমন হবে তোমার আপকামিং হোস্টেল জীবন। তোমার জন্য সর্বোচ্চ ইফোর্ট দিয়ে ভালো লেখার চেষ্টা করেছি আমার ছয় বছরের হোস্টেল জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে।

তোমার হোস্টেল জীবন সুখের হোক হে ডেমিয়ান ভাই। নতুন জীবনে তোমাকে স্বাগতম এবং অনেক অনেক শুভকামনা।

 

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top